বাংলাদেশ এখন এক সংবেদনশীল সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছে। ২০২৪ সালের ছাত্র আন্দোলন যে আশার স্ফুলিঙ্গ জ্বালিয়েছিল, তা এখনো স্থায়ী রাজনৈতিক রূপ পায়নি। অন্তর্বর্তী সরকার ঘোষণা দিয়েছে, আগামী ফেব্রুয়ারিতেই জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। কিন্তু শুধু তারিখ ঘোষণা করাই যথেষ্ট নয়। প্রশ্ন হলো এই নির্বাচন কি সত্যিই গণতন্ত্রের প্রতি আস্থা ফিরিয়ে আনতে পারবে?
রাজনীতি এখন দ্রুত পাল্টাচ্ছে। একসময়ের শক্তিশালী আওয়ামী লীগ জাতীয় নিরাপত্তা আইনের আওতায় কার্যক্রম স্থগিত দেখছে। অন্যদিকে জামায়াতে ইসলামী আদালতের রায়ে আবার রাজনৈতিক ময়দানে ফিরে এসেছে। এসব পরিবর্তন আমাদের পুরোনো অভিজ্ঞতাকেই স্মরণ করিয়ে দেয় যে এক দলের পতন অন্য দলের জন্য জায়গা খুলে দেয়; কিন্তু সাধারণ মানুষের জন্য খুব কমই কিছু বদলায়।
এই অনিশ্চিত প্রেক্ষাপটে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান জানিয়েছেন, তিনি দেশে ফিরে নির্বাচনে অংশ নেবেন। প্রায় দুই দশক ধরে লন্ডনে নির্বাসিত এই রাজনীতিক এখন সংস্কার, অর্থনৈতিক পুনর্গঠন ও প্রতিহিংসামুক্ত রাজনীতির প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন। অনেকেই আগ্রহ নিয়ে দেখছেন; কিন্তু সন্দেহও আছে, বিএনপি কি সত্যিই অতীত থেকে শিক্ষা নিতে পেরেছে?
তারেক রহমানের ফিরে আসা যেমন তার নিজের জন্য একটি পরীক্ষা, তেমনি অন্তর্বর্তী সরকারের জন্যও একটি দায়িত্বের মুহূর্ত। সরকার যদি সত্যিই আইনের শাসনে বিশ্বাস করে, তবে আইন যেন কারও জন্য আশ্রয় না হয়, আবার কারও জন্য অস্ত্রও না হয়। সমান আচরণই হবে এই নির্বাচনপূর্ব সময়ের সবচেয়ে বড় পরীক্ষা।
একটি নির্বাচনের বিশ্বাসযোগ্যতা নির্ভর করে প্রক্রিয়ার ওপর, স্লোগানের ওপর নয়। স্বচ্ছ সময়সূচি, মনোনয়নপ্রক্রিয়ার পরিষ্কার নির্দেশনা এবং সব দলের জন্য সমান প্রতিযোগিতার সুযোগ, এই তিন শর্ত পূরণ হলেই জনগণ ভোটকেন্দ্রে যেতে আস্থা পাবেন। প্রতিটি বিলম্ব, অস্পষ্টতা বা যাচাই–বাছাই করা সেই আস্থা নষ্ট করবে।
কিন্তু নিয়মই সব নয়, বাংলাদেশের জগগণ চায় যে আদালত, পুলিশ ও নির্বাচন কমিশন রাষ্ট্রের পক্ষে কাজ করছে, কোনো দলের নয়। বৈধতা ঘোষণায় আসে না, তা মানুষ অনুভব করে ভোটকেন্দ্রে গিয়ে। যদি তারা ভয়, পক্ষপাত বা অনিয়ম দেখে, তাহলে আন্তর্জাতিক তদারকি দিয়েও সেই ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়া যাবে না।
২০২৪ সালের ছাত্র আন্দোলন এই সমাজকে এক নতুন চেতনা উপহার দিয়েছিল। তরুণেরা রাজনীতিকে নৈতিকতার প্রশ্নে ফিরিয়ে এনেছিলেন। তারা কোনো নতুন নায়ক খুঁজছিলেন না, খুঁজছিলেন ন্যায্যতা ও মর্যাদা। এখন প্রশ্ন হলো, সেই শক্তিটা কি টিকে থাকবে, নাকি পুরোনো ক্ষমতার সংস্কৃতি আবার সবকিছু গ্রাস করবে?
অন্তর্বর্তী সরকারের কাজ হলো এমন একটি নির্বাচন নিশ্চিত করা, যা নিয়ে কারও সন্দেহ থাকবে না। আর বিরোধী দলের দায়িত্ব হলো সেই নির্বাচনে অংশ নিয়ে প্রতিশোধ নয়, সংস্কারের রাজনীতি দেখানো। দুই পক্ষই যদি নিজেদের সীমা ছাড়িয়ে একটু উদার হয়, তাহলে এই ভোট সত্যিকারের নতুন সূচনা হতে পারে।
বাংলাদেশ অনেক বছর ধরেই এমন এক নির্বাচনের অপেক্ষায় আছে, যা সত্যিকার অর্থে জনগণের মনে হবে তাদের নিজের। ফেব্রুয়ারি ২০২৬ সেই সুযোগ এনে দিচ্ছে; কিন্তু সময় খুব দ্রুত ফুরিয়ে যাচ্ছে। এই এক বছরের মধ্যে আমাদের রাজনীতি যদি শৃঙ্খলা, ন্যায্যতা ও সাহস দেখাতে পারে, তাহলে এই নির্বাচন হবে কেবল ক্ষমতার লড়াই নয়, এটি হবে বিশ্বাস পুনর্গঠনের এক নতুন অধ্যায়।
বাংলাদেশ এখনো সেই সুযোগ হারায়নি। প্রশ্ন শুধু—আমরা কি তা কাজে লাগাতে পারব?
- আরিফুর রহমান যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব আলাবামার পিএইচডি গবেষক। তাঁর গবেষণার বিষয় ‘সামাজিক আন্দোলন ও দক্ষিণ এশিয়ার গণতান্ত্রিক রূপান্তর’।

