বুধবার, নভেম্বর ৫, ২০২৫

পর্যটকদের জন্য আবার খুলছে সেন্ট মার্টিন

Must read

৯ মাস পর আগামী ১ নভেম্বর থেকে আবার সেন্ট মার্টিন দ্বীপ ভ্রমণে যেতে পারবেন পর্যটকেরা। প্রতিদিন সর্বোচ্চ দুই হাজার পর্যটক সেন্ট মার্টিনে যাওয়ার সুযোগ পাবেন। তবে পর্যটকদের মানতে হবে সরকারের ১২টি নির্দেশনা।

বঙ্গোপসাগরের বুকে আট বর্গকিলোমিটার আয়তনের প্রবালসমৃদ্ধ দ্বীপ সেন্ট মার্টিনে গত ১ ফেব্রুয়ারি থেকে পর্যটকদের যাতায়াত বন্ধ রয়েছে। এবারও নভেম্বর থেকে জানুয়ারি পর্যন্ত তিন মাস দ্বীপটিতে ভ্রমণের সুযোগ পাবেন পর্যটকেরা।

সরকারি প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী, নভেম্বরে পর্যটকেরা শুধু দিনের বেলায় দ্বীপটি ভ্রমণ করতে পারবেন। রাত যাপন করতে পারবেন না। ডিসেম্বর ও জানুয়ারি দুই মাস রাত যাপনের সুযোগ থাকবে।

এ ছাড়া পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের ১২টি নির্দেশনার মধ্যে রয়েছে বিআইডব্লিউটিএ এবং মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন ছাড়া সেন্ট মার্টিন দ্বীপে কোনো নৌযান চলাচলের অনুমতি পাবে না। পর্যটকদের অবশ্যই বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ডের স্বীকৃত ওয়েব পোর্টালের মাধ্যমে অনলাইনে টিকিট কিনতে হবে। সেখানে প্রতিটি টিকিটে ট্রাভেল পাস এবং কিউআর কোড সংযুক্ত থাকবে। কিউআর কোড ছাড়া টিকিট নকল হিসেবে গণ্য হবে।

পরিবেশ অধিদপ্তরের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, আগামী জানুয়ারি মাস পর্যন্ত সেন্ট মার্টিন দ্বীপে যেতে পারবেন পর্যটকেরা। আগামী বছরের ১ ফেব্রুয়ারি থেকে আবার ৯ মাসের জন্য দ্বীপে পর্যটক যাতায়াত সম্পূর্ণভাবে বন্ধ থাকবে।

দ্বীপে ভ্রমণের সময়সূচি এবং পর্যটক উপস্থিতিও এবার কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রিত থাকবে। ফেব্রুয়ারি মাসে দ্বীপে পর্যটক যাতায়াত সম্পূর্ণভাবে বন্ধ থাকবে। প্রতিদিন গড়ে দুই হাজারের বেশি পর্যটক ভ্রমণ করতে পারবেন না।

প্রাকৃতিক পরিবেশ অক্ষুণ্ন রাখতে রাতে সৈকতে আলো জ্বালানো, শব্দ সৃষ্টি বা বারবিকিউ পার্টি নিষিদ্ধ করা হয়েছে। কেয়াবনে প্রবেশ, কেয়া ফল সংগ্রহ বা ক্রয়–বিক্রয়, সামুদ্রিক কাছিম, পাখি, প্রবাল, রাজকাঁকড়া, শামুক-ঝিনুক ও অন্যান্য জীববৈচিত্র্যের ক্ষতি করা কঠোরভাবে নিষেধ। সৈকতে মোটরসাইকেল, সি-বাইকসহ যেকোনো মোটরচালিত যানবাহন চলাচল সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ থাকবে।

সেন্ট মার্টিনের জীববৈচিত্র্য রক্ষায় সরকারের জারি করা ১২টি নির্দেশনা কঠোরভাবে বাস্তবায়ন করবে জেলা প্রশাসন। আগে টেকনাফ থেকে পর্যটকবাহী জাহাজ চলাচল করলেও নিরাপত্তার কারণে এখন কক্সবাজার শহর থেকে পর্যটকবাহী জাহাজ বঙ্গোপসাগর পাড়ি দিয়ে সেন্ট মার্টিন যাতায়াত করবে।

মো. আবদুল মান্নান, কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক

নিষিদ্ধ পলিথিন বহন করা যাবে না এবং একবার ব্যবহার্য প্লাস্টিক, যেমন চিপসের প্যাকেট, প্লাস্টিক চামচ, স্ট্র, সাবান ও শ্যাম্পুর মিনিপ্যাক, ৫০০ ও ১০০০ মিলিলিটারের প্লাস্টিক বোতল ইত্যাদি বহন নিরুৎসাহিত করা হয়েছে। পর্যটকদের নিজস্ব পানির ফ্লাস্ক সঙ্গে রাখার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।

কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মো. আবদুল মান্নান প্রথম আলোকে বলেন, সেন্ট মার্টিনের জীববৈচিত্র্য রক্ষায় সরকারের জারি করা ১২টি নির্দেশনা কঠোরভাবে বাস্তবায়ন করবে জেলা প্রশাসন। আগে টেকনাফ থেকে পর্যটকবাহী জাহাজ চলাচল করলেও নিরাপত্তার কারণে এখন কক্সবাজার শহর থেকে পর্যটকবাহী জাহাজ বঙ্গোপসাগর পাড়ি দিয়ে সেন্ট মার্টিন যাতায়াত করবে।

সেন্ট মার্টিন রুটের পর্যটকবাহী জাহাজমালিকদের সংগঠন ‘সি ক্রুজ অপারেটর ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ’-এর সাধারণ সম্পাদক হোসাইন ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, কক্সবাজার-সেন্ট মার্টিন রুটে জাহাজ চলাচলের ক্ষেত্রে বিআইডব্লিউটিএর অনুমোদন লাগে। কয়েক দিনের মধ্যে অনুমোদন পাওয়া গেলে নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে জাহাজ চলাচল শুরু করা সম্ভব হবে। গত মৌসুমে (তিন মাসে) ১ লাখ ২০ হাজারের মতো পর্যটক সেন্ট মার্টিন ভ্রমণ করেছেন বলে জানান তিনি।

পরিবেশ অধিদপ্তরের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, আগামী জানুয়ারি মাস পর্যন্ত সেন্ট মার্টিন দ্বীপে যেতে পারবেন পর্যটকেরা। আগামী বছরের ১ ফেব্রুয়ারি থেকে আবারও ৯ মাসের জন্য দ্বীপে পর্যটক যাতায়াত সম্পূর্ণভাবে বন্ধ থাকবে।

পর্যটক সীমিত করার উদ্যোগের প্রথম ৯ মাসে সেন্ট মার্টিনের পরিবেশ-প্রতিবেশের ব্যাপক উন্নতি ঘটেছে। এখন সৈকতজুড়ে লাল কাঁকড়া, শামুক-ঝিনুকের বংশবিস্তার ঘটেছে। সৈকতে পর্যটকের উপচে পড়া ভিড় না থাকায় মা কাছিমের ডিম পাড়ার পরিবেশ তৈরি হয়েছে।

শামুক-ঝিনুকের বিচরণ বেড়েছে

পরিবেশ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, প্রতিবেশ সংকটাপন্ন সেন্ট মার্টিনে প্রবাল, শৈবাল, কাছিম, শামুক, ঝিনুক, সামুদ্রিক মাছ, পাখি, স্তন্যপায়ী প্রাণী, কাঁকড়াসহ ১ হাজার ৭৬ প্রজাতির জীববৈচিত্র্য রয়েছে। অতীতে অনিয়ন্ত্রিতভাবে অবকাঠামো নির্মাণ, বিপুল পর্যটকের সমাগম ও পরিবেশদূষণের কারণে দ্বীপটি সংকটাপন্ন হয়ে পড়েছিল। তবে গত ৯ মাস সেন্ট মার্টিনে পর্যটকের যাতায়াত বন্ধ থাকায় দ্বীপের জীববৈচিত্র্য বিস্তার ও পরিবেশের উন্নতি হয়েছে।

সেন্ট মার্টিনের বাসিন্দা ও জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আগে মৌসুমের সময় পর্যটকবাহী ৪০০ ইজিবাইক ও ২০০ মোটরসাইকেল সৈকত দিয়ে চলাচল করত। এতে শামুক-ঝিনুকসহ বিভিন্ন সামুদ্রিক প্রাণী মরে যায়। গত ৯ মাস পর্যটক না থাকায় সৈকতে শামুক-ঝিনুকের বংশবিস্তার ঘটছে। প্রবাল–শৈবাল আহরণ বন্ধ আছে। তবে পর্যটক না থাকায় দ্বীপের কয়েক হাজার মানুষ আর্থিক কষ্টে পড়েছেন। তাঁদের জীবিকা নির্বাহের বিকল্প ব্যবস্থা নেই।

নভেম্বর মাসে পর্যটকদের রাতযাপনের সুযোগ না দেওয়ার সিদ্ধান্তের কারণে সেন্ট মার্টিনের পর্যটন খাতে বিনিয়োগকারীরা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন বলে দাবি করেছেন দ্বীপের হোটেল-রেস্তোরাঁ ও দোকানমালিকেরা।

পরিবেশবিষয়ক সংগঠন ইয়ুথ এনভায়রনমেন্ট সোসাইটি (ইয়েস) কক্সবাজারের প্রধান নির্বাহী ইব্রাহিম খলিল বলেন, পর্যটক সীমিত করার উদ্যোগের প্রথম ৯ মাসে সেন্ট মার্টিনের পরিবেশ-প্রতিবেশের ব্যাপক উন্নতি ঘটেছে। এখন সৈকতজুড়ে লাল কাঁকড়া, শামুক-ঝিনুকের বংশবিস্তার ঘটেছে। সৈকতে পর্যটকের উপচে পড়া ভিড় না থাকায় মা কাছিমের ডিম পাড়ার পরিবেশ তৈরি হয়েছে।

‘সেন্ট মার্টিনের দ্বীপের জীববৈচিত্র্য ও জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় অভিযোজন প্রকল্প’ নামে ৮ কোটি ৯০ লাখ টাকার একটি প্রকল্পের কাজ চলছে দ্বীপটিতে। এ প্রকল্পের পরিচালক ও পরিবেশ অধিদপ্তরের কর্মকর্তা কামরুল হাসান প্রথম আলোকে বলেন, ছেঁড়াদিয়া, গোলদিয়া ও দিয়ারমাথা পরিদর্শন করে তিনি প্রবাল-শৈবাল বিস্তারের দৃশ্য দেখেছেন। শৈবাল ও চুনাপাথরের গায়ে অজস্র শামুক-ঝিনুক আঁকড়ে আছে। বালুচরে শামুক-ঝিনুকের বিচরণ চোখে পড়েছে। বালিয়াড়িতে প্যারাবন মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে। প্যারাবনে ব্যাঙ, সাপ, টিকটিকি, প্রজাপতিসহ বিভিন্ন প্রাণীর বিচরণ দেখা গেছে, যা দুই বছর আগে ছিল না।

দ্বীপে পানীয় জলের সংকট নিরসন, বেওয়ারিশ কুকুরের প্রজনন ঠেকাতে বন্ধ্যাকরণ প্রকল্প, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, বর্জ্য থেকে জ্বালানি ও বিদ্যুৎ উৎপাদন, বনায়ন এবং জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ, নতুন জেটি নির্মাণসহ শত কোটি টাকার একাধিক প্রকল্পের কাজ চলছে। ডিসেম্বরের মধ্যে এসব প্রকল্পের কাজ শেষ হলে দ্বীপের মানুষের সংকট দূর হবে।

বিনিয়োগকারীদের ক্ষতির আশঙ্কা

নভেম্বর মাসে পর্যটকদের রাতযাপনের সুযোগ না দেওয়ার সিদ্ধান্তের কারণে সেন্ট মার্টিনের পর্যটন খাতে বিনিয়োগকারীরা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন বলে দাবি করেছেন দ্বীপের হোটেল-রেস্তোরাঁ ও দোকানমালিকেরা।

সেন্ট মার্টিন দোকান মালিক সমিতির সহসভাপতি নুর মোহাম্মদ বলেন, দুই বছর আগেও মৌসুমের পাঁচ মাস পর্যটকেরা দ্বীপে রাত যাপন করতেন। এখন সেই সুযোগ না থাকায় দোকানে বেচাবিক্রি নেই। ৬০-৭০টি দোকান বন্ধ রয়েছে।

সেন্ট মার্টিন হোটেল-রিসোর্ট মালিক সমিতির সভাপতি শিবলুল আযম কোরেশী বলেন, ‘পরিবেশ রক্ষার ক্ষেত্রে সরকারি সিদ্ধান্তকে আমরা স্বাগত জানাই। কিন্তু পরিবেশ রক্ষার নামে বিনিয়োগকারীদের পথে বসিয়ে, দ্বীপের মানুষের জীবন-জীবিকা ঝুঁকিতে ফেলে ভালো পর্যটন আশা করা যায় না।’ আগের মতো মৌসুমের পাঁচ মাস (অক্টোবর থেকে ফেব্রুয়ারি) সেন্ট মার্টিনে পর্যটকের রাতযাপনের সুযোগ দেওয়ার দাবি জানান তিনি।

পরিবেশ অধিদপ্তর চট্টগ্রাম অঞ্চলের পরিচালক মো. জমির উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, দ্বীপে পানীয় জলের সংকট নিরসন, বেওয়ারিশ কুকুরের প্রজনন ঠেকাতে বন্ধ্যাকরণ প্রকল্প, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, বর্জ্য থেকে জ্বালানি ও বিদ্যুৎ উৎপাদন, বনায়ন এবং জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ, নতুন জেটি নির্মাণসহ শত কোটি টাকার একাধিক প্রকল্পের কাজ চলছে। ডিসেম্বরের মধ্যে এসব প্রকল্পের কাজ শেষ হলে দ্বীপের মানুষের সংকট দূর হবে।

- Advertisement -spot_img

More articles

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisement -spot_img

Latest article