বুধবার, নভেম্বর ৫, ২০২৫

এআই দিয়ে দেখানো হচ্ছে লোভনীয় বিজ্ঞাপন, ‘পুরোনো ব্যবসা’ বলে প্রতারণা

Must read

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) ব্যবহার করে অনলাইন প্রতারণার নতুন কৌশল নিয়েছে কিছু বিদেশি প্রতিষ্ঠান। এআই দিয়ে তৈরি ছবি ও মনগড়া গল্পের মাধ্যমে তারা নিজেদের যুক্তরাজ্যের পারিবারিক ব্যবসা হিসেবে উপস্থাপন করছে। অনেক ক্রেতা এসব ওয়েবসাইটে বিশ্বাস করে পণ্য কিনে পরে বুঝতে পারছেন, তাঁরা প্রতারিত হয়েছেন। কারণ, এসব পণ্য আসলে স্থানীয় কোনো দোকান থেকে নয়, পাঠানো হচ্ছে পূর্ব এশিয়ার গুদামঘর থেকে।

এমনই একটি ভুয়া অনলাইন দোকান ‘সে লা ভি’। ওয়েবসাইটে দাবি করা হয়, বার্মিংহামের ঐতিহাসিক গয়নার পল্লিতে এলিন ও প্যাট্রিক নামের এক দম্পতি ২৯ বছর ধরে এই পারিবারিক ব্যবসা চালাচ্ছেন। কিন্তু পণ্য ফেরত পাঠানোর ঠিকানায় দেখা গেছে, সেটির অবস্থান চীনে। ব্রিটিশ ভোক্তা সুরক্ষা সংস্থা ‘উইচ’ বলছে, এআইনির্ভর প্রযুক্তির মাধ্যমে প্রতারকেরা ভোক্তাদের বিভ্রান্ত করতে পারছে।

আরেকটি ওয়েবসাইট ‘মেবেল অ্যান্ড ডেইজি’ নিজেদের ব্রিস্টলভিত্তিক মা ও মেয়ের মালিকানাধীন পোশাক ব্র্যান্ড হিসেবে প্রচার করছে। কিন্তু এর ব্যবসায়িক ঠিকানাও হংকংয়ে। রিভিউ প্ল্যাটফর্ম ট্রাস্টপাইলটে এই দুটি ওয়েবসাইটের বিরুদ্ধে পাঁচ শতাধিক এক তারকা রেটিং জমা পড়েছে। অনেকেই অভিযোগ করেছেন, তাঁরা উচ্চমূল্যে নিম্নমানের পণ্য পেয়েছেন এবং ফেরত পাঠাতে দিতে হয়েছে অতিরিক্ত ফি। বেশির ভাগ ক্রেতা জানিয়েছেন, তাঁরা ফেসবুক দেখার সময় এসব দোকানের বিজ্ঞাপন দেখেছিলেন।

যুক্তরাজ্যের বিজ্ঞাপন নিয়ন্ত্রণ সংস্থা অ্যাডভার্টাইজিং স্ট্যান্ডার্ডস এজেন্সি (এএসএ) সম্প্রতি ‘মার্বেল মিউজ’ নামের একটি চীনা পোশাক ব্র্যান্ডের বিজ্ঞাপন নিষিদ্ধ করেছে। প্রতিষ্ঠানটি নিজেদের লন্ডনভিত্তিক হিসেবে প্রচার করছিল। এএসএ বলছে, এসব প্রতারণা ঠেকাতে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোকেও দায়িত্ব নিতে হবে।

ওয়েবসাইটে হাস্যোজ্জ্বল মুখ, গয়না ও ব্র্যান্ডের পোশাকে সজ্জিত আলমারি সব মিলিয়ে এলিন ও প্যাট্রিককে দেখা যায় সফল এক দম্পতির রূপে। কিন্তু কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাবিদেরা বলছেন, ছবিগুলো এত নিখুঁত ও সাজানো যে সেগুলো বাস্তব হওয়ার সম্ভাবনা নেই। বার্মিংহাম বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাবিদ অধ্যাপক মার্ক লি বলেন, আগে বোঝা যেত কোন ছবি এআই দিয়ে তৈরি। কারণ, বাস্তবসম্মত হাত বা আঙুল ফুটিয়ে তুলতে পারত না। এখন ছবিগুলো এত নিখুঁতভাবে তৈরি হচ্ছে যে তা বাস্তব মনে হলেও আসলে কৃত্রিম।

সে লা ভির সাম্প্রতিক বিজ্ঞাপনে দেখা যায়, দোকানের মালিক এলিন তাঁর ‘প্রিয় স্বামী’ প্যাট্রিককে হারিয়ে ব্যবসা বন্ধ করছেন এবং শেষবারের মতো ৮০ শতাংশ ছাড় দিচ্ছেন। সেখানে লেখা ছিল, ‘আমার স্বামীকে হারানোর পর থেকে আমি লড়াই করে যাচ্ছি, কিন্তু শোক আমাকে নিঃশেষ করে দিয়েছে। তাই আমাদের হাতে তৈরি গয়নার দোকানটি বন্ধ করতে বাধ্য হচ্ছি।’ এই গল্পে বিশ্বাস করে অনেকেই পণ্য কিনেছিলেন। পরে ট্রাস্টপাইলটে ক্ষোভ প্রকাশ করে কেউ লিখেছেন, ‘গয়নার বদলে পেয়েছি রজনের টুকরা আর সস্তা ধাতব আবর্জনা। আরেকজন লিখেছেন, জিরো রেটিং দিতে পারলে দিতাম। পুরোপুরি প্রতারণা। বার্মিংহামে এমন কোনো কোম্পানি নেই। বিশ্বাসই করতে পারছি না, এমন ফাঁদে পা দিয়েছি।’

বার্মিংহামের আস্টেলা জুয়েলারির মালিক সানি পাল বলেন, এসব ভুয়া ব্যবসা স্থানীয় উদ্যোক্তাদের সুনাম নষ্ট করছে। ‘এই মিথ্যা প্রচারণা আসল ও ভুয়া ব্যবসার সীমারেখা মুছে দিচ্ছে। এতে স্থানীয় ব্যবসার বিশ্বাসযোগ্যতা ক্ষুণ্ন হচ্ছে,’ বলেন তিনি। বিবিসি প্রথমবার সে লা ভির সঙ্গে যোগাযোগ করার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই ওয়েবসাইটে ঘোষণা দেওয়া হয়, সব পণ্য বিক্রি হয়ে গেছে এবং ব্যবসা বন্ধ হচ্ছে। কিছু সময় পর দোকানের নাম বদলে যায় অ্যালিস অ্যান্ড ফ্রেড। পরে আবার আগের নামে ফিরে আসে। কোম্পানিটি বিবিসিকে কোনো মন্তব্য জানায়নি।

ব্রিস্টলভিত্তিক দাবি করা মেবেল অ্যান্ড ডেইজি থেকে ৪০ পাউন্ডে একটি ফুলেল পোশাক কিনেছিলেন জাস্টিন গফ। কয়েক সপ্তাহ পর সেটি হাতে পেয়ে তিনি বুঝতে পারেন, এটি পুরোপুরি প্রতারণা। কারণ, পোশাকটি ছবির সঙ্গে কোনো মিল নেই, আর কাপড়ের মান ছিল ভয়ানক। তিনি বলেন, ‘ওয়েবসাইটটি পেশাদার ও বিশ্বাসযোগ্য মনে হয়েছিল। কিন্তু টাকা কেটে নেওয়ার পরও পণ্য পৌঁছাতে দেরি হওয়ায় আমাকে একাধিকবার ই-মেইল করতে হয়েছে।’ পণ্য ফেরত দিতে গেলে তাঁকে জানানো হয়, খরচ হবে ২০ পাউন্ড। শেষ পর্যন্ত তিনি অর্ধেক অর্থ ফেরত পান। বার্মিংহামের আরেক ক্রেতা এমা জানান, তিনি ৫০ পাউন্ডে একটি জ্যাকেট কিনেছিলেন। সেটি অনেক বড় হওয়ায় ফেরত দিতে গেলে তাঁকে বলা হয়, বাড়তি ১০ পাউন্ড দিলে ছোট মাপের আরেকটি পাঠানো হবে। তিনি বলেন, ‘তখনই বুঝলাম, এটি প্রতারণা। কারণ, টাকা দেওয়ার সময় ওয়েবসাইটে হঠাৎ চীনা অক্ষর দেখা গিয়েছিল।’ বিবিসি যোগাযোগ করলে মেবেল অ্যান্ড ডেইজিও কোনো মন্তব্য জানায়নি।

গত মাসে বিবিসির ‘ওয়াচডগ’–এর অভিযোগের পর এএসএ একটি তথাকথিত ‘ব্রিটিশ’ পোশাক কোম্পানির বিজ্ঞাপন নিষিদ্ধ করে। কোম্পানিটি গোলাপ, পাথুরে রাস্তা ও ইউনিয়ন জ্যাকের ছবি ব্যবহার করে নিজেদের ব্রিটিশ ব্র্যান্ড হিসেবে উপস্থাপন করেছিল, অথচ তাদের পণ্য পাঠানো হচ্ছিল এশিয়ার গুদাম থেকে। সংস্থাটি জানিয়েছে, বিভ্রান্তিকর বিজ্ঞাপনের বিরুদ্ধে তাদের পদক্ষেপ অব্যাহত থাকবে। তবে মুখপাত্রের ভাষায়, ‘এ সমস্যা সমাধানে অন্যান্য নিয়ন্ত্রক সংস্থা ও বিজ্ঞাপন মাধ্যমগুলোকেও দায়িত্ব নিতে হবে।’

ভোক্তা অধিকার সংগঠন উইচের প্রতিনিধি সু ডেভিস বলেন, স্থানীয় ট্রেডিং স্ট্যান্ডার্ড দলগুলো পর্যাপ্ত জনবল ও সম্পদ না থাকায় অনেক প্রতারণামূলক ওয়েবসাইট তদন্তের বাইরে থেকে যাচ্ছে। তিনি বলেন, ভোক্তাদের ওপর দায় থাকা উচিত নয়, তবে কিছু সাবধানতা অবলম্বন করে ঝুঁকি কমানো সম্ভব।

ডেভিসের পরামর্শ, কোনো পণ্য কেনার আগে অনলাইনে রিভিউ পড়া, অন্য ক্রেতাদের অভিজ্ঞতা দেখা এবং কোম্পানির শর্তাবলি ভালোভাবে পড়ে দেখা জরুরি। শর্তাবলিতে প্রায়ই কোম্পানির প্রকৃত অবস্থান জানা যায়। অধ্যাপক মার্ক লি বলেন, ‘বাস্তব মানুষের উপস্থিতি বোঝার জন্য ছবিতে ভিন্ন প্রেক্ষাপট, আলাদা পটভূমি ও চেনা স্থান আছে কি না, তা খেয়াল করা যেতে পারে।’ তবে তিনি সতর্ক করে বলেন, এআই দ্রুত উন্নত হচ্ছে। সামনে নতুন প্রশ্নটা হবে ওয়েবসাইটের পেছনে আদৌ কোনো মানুষ আছে কি না।

সূত্র: বিবিসি ডটকোডটইউকে

- Advertisement -spot_img

More articles

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisement -spot_img

Latest article