অগণিত মৃত্যু ও ধ্বংসের দৃশ্যের পর এবার পর্দায় দেখা গেল আনন্দের ছবি। সে ছবি যেন কিছুটা স্বস্তি এনে দিল। বৃহস্পতিবার বিশ্বজুড়ে টেলিভিশনের পর্দা দুই ভাগে ভাগ হয়ে গেল। এক ভাগে গাজার মানুষের উল্লাস, অন্য ভাগে ইসরায়েলের মানুষের। দুই দিকেই করতালি আর উচ্ছ্বাস। যেন মানুষ নিজেরাই জানিয়ে দিচ্ছে, এ যুদ্ধের শেষ তারা অনেক আগেই শেষ দেখতে চেয়েছিল।
তবে এ দৃশ্যও কিন্তু একদম নতুন নয়। এর আগেও জানুয়ারিতে যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করা হলে এমনই উল্লাস করা হয়েছিল। কিন্তু মার্চের মধ্যভাগে ইসরায়েল সেই চুক্তি ভেঙে আবার গাজায় হামলা চালায়। তাই এবারও আশা থাকলেও মানুষ সাবধান—যেকোনো সময় পরিস্থিতি আবার মোড় নিতে পারে। তবু মধ্যপ্রাচ্যের সবচেয়ে নিরাশাবাদীরাও স্বীকার করছেন, এবার চুক্তিটা বেশ টেকসই মনে হচ্ছে।
সাধারণত এমন কোনো বড় অগ্রগতি হয় দুই পক্ষের সমান সমঝোতার ফলে। প্রথম দৃষ্টিতে মনে হতে পারে, এখানেও তা–ই ঘটেছে। হামাস দুর্বল হয়ে পড়েছিল, ইসরায়েল তার শীর্ষ নেতাদের হত্যা করেছে, ইরানের মতো পৃষ্ঠপোষককেও দুর্বল করেছে।
অন্যদিকে ডোনাল্ড ট্রাম্প হামাসের ওপর প্রভাব আছে এমন দেশগুলো, যেমন কাতার, তুরস্ক, মিসরকে হামাসকে রাজি করানোর জন্য চাপ দিয়েছিলেন। এমনকি কাতারের সঙ্গে একটি প্রতিরক্ষা চুক্তি করে তাদের ন্যাটো স্তরের নিরাপত্তাসুবিধাও দিয়েছেন।
তবু হামাসের অবস্থানে বড় কোনো পরিবর্তন আসেনি। নেতানিয়াহুর ঘনিষ্ঠদের দাবি সত্ত্বেও হামাস তার মৌলিক অবস্থান থেকে সরে যায়নি। ট্রাম্পের ২০ দফা পরিকল্পনায় হামাসকে অস্ত্র সমর্পণের কথা বলা হলেও বর্তমান যুদ্ধবিরতি চুক্তিতে এর কোনো উল্লেখ নেই।
শুরু থেকেই হামাসের অবস্থান ছিল পরিষ্কার—যদি ইসরায়েল ফিলিস্তিনি বন্দীদের ছাড়ে, গাজা থেকে সেনা প্রত্যাহার করে এবং যুদ্ধ বন্ধ করে, তাহলেই তারা জিম্মিদের মুক্তি দেবে। এখন ইসরায়েল মোটামুটি সেটিই মেনে নিয়েছে, যদিও সেনা প্রত্যাহার করা হবে ধাপে ধাপে। ইসরায়েলি সামরিক গোয়েন্দা বিভাগের সাবেক কর্নেল মাইকেল মিলস্টেইন বলেছেন, সত্যি বলতে, হামাস তার মৌলিক অবস্থানে কোনো নাটকীয় পরিবর্তন আনেনি।
অর্থাৎ আসল অবস্থান বদল ঘটেছে ইসরায়েলের দিকেই। কয়েক দিন আগেও নেতানিয়াহু জাতিসংঘে বলেছিলেন, হামাস পুরোপুরি ধ্বংস না হওয়া পর্যন্ত যুদ্ধ চলবে। আর এখন তিনিই এমন চুক্তিতে রাজি হয়েছেন, যেখানে হামাস টিকে থাকছে। যেটা আগে অসম্ভব বলেছিলেন, এখন সেটাই মেনে নিচ্ছেন।
প্রশ্ন হচ্ছে, নেতানিয়াহুকে কীভাবে রাজি করালেন ট্রাম্প? সোজা উত্তর—ট্রাম্প অবশেষে তাঁর ক্ষমতার পূর্ণ ব্যবহার করলেন এবং যুদ্ধ থামাতে চূড়ান্ত নির্দেশ দিলেন। তিনি স্পষ্ট করে জানিয়ে দিলেন, তাঁর ধৈর্যের সীমা শেষ। নেতানিয়াহুর আর কারও কাছে যাওয়ার পথ খোলা ছিল না।
গত দুই বছরে তিনি প্রাচীন মিত্রদেশগুলো পর্যন্ত দূরে ঠেলে দিয়েছেন। ফলে তাঁর নির্ভরতা এখন কেবল ট্রাম্পের ওপর। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট যখন বললেন, ‘যুদ্ধ শেষ করতে হবে’, তখন আর কোনো বিকল্প ছিল না। ট্রাম্প নেতানিয়াহুকে সরাসরি বলেছিলেন, ইসরায়েল পুরো বিশ্বের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে পারে না।
বিশ্লেষকদের মতে, ৯ সেপ্টেম্বর দোহায় হামাসের আলোচনাকারী দলের ওপর ইসরায়েলের ব্যর্থ হামলাই ট্রাম্পের ধৈর্য শেষ করে দেয়। ট্রাম্পকে সে বিষয়ে আগেভাগে কিছু জানানো হয়নি, অথচ হামলাটা হয়েছে কাতারের ভূখণ্ডে। কাতার হলো সেই দেশ, যে দেশ ট্রাম্পের ব্যক্তিগত বন্ধু ও ব্যবসায়িক অংশীদার।
মনে রাখতে হবে, কাতার ট্রাম্পকে নতুন প্রেসিডেন্ট বিমান বা এয়ারফোর্স ওয়ানও উপহার দিয়েছিল। ফলে কাতারে ইসরায়েলের হামলাকে ট্রাম্প ব্যক্তিগত অপমান হিসেবে নিয়েছেন। যেন কোনো মাফিয়া বসের সহযোগীর ওপর হামলা হয়েছে এবং বস নিজে দেখিয়ে দিতে চান, সবকিছুর কলকাঠি আসলে কার হাতে।
ট্রাম্পের যুদ্ধ থামানোয় আগ্রহী হওয়ার আরও একটি কারণ আছে। ট্রাম্প লক্ষ করেছেন, খোদ ইসরায়েলে রাস্তায় বিক্ষোভ বেড়ে যাচ্ছে, মানুষ যুদ্ধের অবসান চায়। বিশ্বের নানা প্রান্তে ইসরায়েলের গাজা ধ্বংসযজ্ঞের বিরুদ্ধে ক্ষোভ জেগে উঠেছে।
ট্রাম্প বুঝলেন, এখন যদি তিনি যুদ্ধবিরতি ঘটাতে পারেন, তবে তাঁর ভাবমূর্তি অনেক উজ্জ্বল হবে। এটিকে তাঁর নোবেল শান্তি পুরস্কার পাওয়ার সবচেয়ে বড় সুযোগ বলে মনে হয়েছে বলে প্রতীয়মান হয়।

যুদ্ধবিরতির পর মেয়েকে নিয়ে গাজার মধ্যাঞ্চলের নুসেইরাত থেকে নেৎজারিম করিডর দিয়ে গাজা নগরীতে ফিরছেন এই নারী । ১০ অক্টোবর, ২০২৫ছবি: এএফপি
ট্রাম্প কি এখন এ যুদ্ধবিরতির নায়ক? যাঁরা এত দিন ট্রাম্পের বিরোধিতা করেছেন, তাঁদের জন্য এটা মেনে নেওয়া কঠিন। কিন্তু সত্যটা হলো এ মুহূর্তে তিনি এ কৃতিত্বের দাবিদার। তাঁর কঠোর মনোভাব, চাপপ্রয়োগের ক্ষমতা, বৈশ্বিক মনোযোগ আকর্ষণের দক্ষতা—সবকিছু এবার তিনি প্রয়োগ করেছেন রক্তপাত থামানো এবং জিম্মিদের মুক্ত করার এক মহৎ লক্ষ্যে।
সব মিলিয়ে একজন মার্কিন প্রেসিডেন্টের হাতে যে বিশাল ক্ষমতা থাকে, ট্রাম্প সেটি এবার পুরোপুরি কাজে লাগিয়েছেন। আর ফলও মিলল—সব টুকরা দ্রুত জায়গামতো বসে গেল।
তাহলে ট্রাম্প কি এখন এ যুদ্ধবিরতির নায়ক? যাঁরা এত দিন ট্রাম্পের বিরোধিতা করেছেন, তাঁদের জন্য এটা মেনে নেওয়া কঠিন। কিন্তু সত্যটা হলো এ মুহূর্তে তিনি এ কৃতিত্বের দাবিদার। তাঁর কঠোর মনোভাব, চাপপ্রয়োগের ক্ষমতা, বৈশ্বিক মনোযোগ আকর্ষণের দক্ষতা—সবকিছু এবার তিনি প্রয়োগ করেছেন রক্তপাত থামানো এবং জিম্মিদের মুক্ত করার এক মহৎ লক্ষ্যে।
যুদ্ধবিধ্বস্ত গাজার মানুষদের জন্য আপাতত সেটাই সবচেয়ে বড় স্বস্তির বার্তা।
ট্রাম্প যখন ২০ জানুয়ারি হোয়াইট হাউসে ফিরে এলেন, তখন এ রকমই এক যুদ্ধবিরতি চুক্তি কার্যত প্রস্তুত অবস্থায় ছিল। কিন্তু মার্চে নেতানিয়াহু যখন সেই যুদ্ধবিরতি ভাঙলেন, তখন ট্রাম্প চাইলে সোজাসুজি বাধা দিতে পারতেন। বলতে পারতেন ‘না, এটা চলবে না।’ এর বদলে তিনি বরং সবুজ সংকেত দিলেন। তার পরের ছয় মাসই হলো যুদ্ধের সবচেয়ে ভয়াবহ সময়। অর্থাৎ ট্রাম্পের হাতে যুদ্ধ থামানোর ক্ষমতা ছিল, কিন্তু তিনি সেটি ব্যবহার করেননি।
অবশ্য এ সমালোচনার চেয়েও বড় দায় নেতানিয়াহুর নিজের। কারণ, তিনি যে চুক্তিতে এখন রাজি হয়েছেন, তার প্রায় একই রকম প্রস্তাব ২০২৪ সালের জুনেই দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু তিনি তা প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। আর পরের অনুরূপ প্রস্তাবগুলোও ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। প্রতিবারই তিনি ভেবেছেন, চলমান যুদ্ধই তাঁর ব্যক্তিগত ও রাজনৈতিক স্বার্থ রক্ষা করবে।
জো বাইডেনেরও কিছু দায় আছে। তিনিও যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব ব্যবহার করে যুদ্ধ থামানোর চেষ্টা করেননি।
শুধু মার্চের ওই সময়ের দিকেই যদি তাকাই, তাহলে বোঝা যায়, এর মধ্যে কত কিছু নষ্ট হয়ে গেছে।
গাজায় অগণিত ফিলিস্তিনি জীবন ধ্বংস হয়ে গেছে। ত্রাণ বন্ধ করে দেওয়ার কারণে তীব্র ক্ষুধা ও বঞ্চনায় গাজাবাসী চরম কষ্ট পেয়েছেন।
আর ইসরায়েলও যথেষ্ট ক্ষতির শিকার হয়েছে। সাত মাস ধরে জিম্মিদের বন্দিদশায় থাকতে হয়েছে, যুদ্ধে অনেক সেনা নিহত হয়েছেন, গাজায় মানবিক সাহায্য বন্ধ করায় ইসরায়েলের আন্তর্জাতিক ভাবমূর্তির ভেঙে পড়েছে এবং দেশটি কার্যত একঘরে হয়ে পড়েছে।
ইসরায়েলি বিশ্লেষক মাইকেল মিলস্টেইন বলছেন, ‘এটা সত্যিই এক বিপর্যয়। কারণ, আমরা যেন এক দীর্ঘ পথ পেরিয়ে আবার ঠিক একই জায়গায় ফিরে এসেছি।’
অবশ্য হামাসকেও দায়মুক্ত বলা যায় না। কারণ, তারা চাইলে অনেক আগেই সব জিম্মিকে ছেড়ে দিয়ে গাজার এ দুর্ভোগের অবসান ঘটাতে পারত।
ট্রাম্প আপাতত নোবেল পুরস্কার পাননি, অন্তত এ বছর নয়। কিন্তু যদি সত্যিই সেটি চান, তবে এখন তাঁর করণীয় স্পষ্ট।
ট্রাম্পকে আসন্ন মাসগুলোতেও, এমনকি বছরজুড়ে সেই একইভাবে সম্পৃক্ত থাকতে হবে, যেমন গত ১০ দিন তিনি সম্পৃক্ত ছিলেন। কারণ, তাঁর ঘোষিত ২০ দফা পরিকল্পনার প্রতিটি দফায় এমন সব জটিলতা আছে, যা যেকোনো সময় পুরো চুক্তিকে ধসিয়ে দিতে পারে।
সবচেয়ে বড় বিষয়, ট্রাম্পকে নেতানিয়াহুর ওপর নজর রাখতে হবে। কারণ, নেতানিয়াহু চুক্তির এই প্রথম ধাপটুকু বাস্তবায়ন করে থেমে যেতে পারেন, পরের ধাপে আর না–ও এগোতে পারেন।
যদি ট্রাম্প সত্যিই ‘নোবেল পুরস্কার’ চান, তবে এটাই তাঁর একমাত্র পথ।
- জনাথন ফ্রিডল্যান্ড দ্য গার্ডিয়ানের কলাম লেখক।

