বুধবার, নভেম্বর ৫, ২০২৫

জাহাজে ঢাকার পূর্বাচল থেকে ঘুরে এলাম টাঙ্গুয়ার হাওর

Must read

বছর দুই ধরে ঢাকা থেকে নৌপথে টাঙ্গুয়ার হাওরে যাওয়ার পরিকল্পনা করছিলাম। সেই সুযোগ হলো গত মাসে। আমাদের তিন সদস্যের পরিবার। সপ্তাহের শেষ দিন নির্ধারিত সময় বিকেল সাড়ে পাঁচটায় পৌঁছে গেলাম পূর্বাচলের শিমুলিয়া বিআইডব্লিউটিএ ঘাটের জেটি। এখানেই নোঙর করা জাহাজে উঠে পড়লাম।

২৮টি কেবিনে ৭৫ জন অতিথি ধারণক্ষমতার জাহাজটি দোতলা। নিচের তলায়ই বেশির ভাগ কেবিন। কয়েকটি ট্রিপল আর বাকিগুলো ডাবল বেড। প্রতিটি রুমে অ্যাটাচড টয়লেট আর শীতাতপনিয়ন্ত্রণব্যবস্থাও আছে। দোতলায় বিশাল ডাইনিং হল, অবশিষ্ট কেবিন আর মাস্টারব্রিজ। মাস্টারব্রিজের ওপরে বিশাল ছাদে চেয়ার–টেবিল দিয়ে বসার ব্যবস্থা।

জাহাজের সুপরিসর দুটি কক্ষের একটি প্রায় তিন মাস আগে বুকিং দিয়েছি। চাবি নিয়ে কেবিনে লাগেজ রাখতেই সান্ধ্যনাশতার ঘোষণা এল। চাওমিন আর চা খেতে খেতেই জাহাজ ছেড়ে দিল। কাঞ্চন ব্রিজ পেরিয়ে শীতলক্ষ্যা নদী বেয়ে আমরা এগিয়ে চললাম।

আমার বিবেচনায় এই জাহাজের সবচেয়ে সুন্দর জায়গা ছাদ। শরতের সন্ধ্যায় ছাদে বসে আড্ডা দিতে দিতে অনেক সহযাত্রীর সঙ্গে পরিচয় হলো। পরিচিত কয়েকজনকেও পেয়ে গেলাম। বেশির ভাগই পরিবার নিয়ে এসেছেন। তিন প্রজন্মের কয়েকটি পরিবারের সঙ্গে আলাপ হয়ে খুব ভালো লাগল। কাঁচপুর ব্রিজের নিচ দিয়ে নারায়ণগঞ্জের বন্দর থানায় এসে তেলের ভাসমান পাম্প থেকে তেল নিল জাহাজ। এর পরপরই রাতের খাবারের ডাক। খাওয়া শেষে অর্ধেকের বেশি যাত্রীকে পাওয়া গেল খোলা ছাদে। গান, গল্প আর আকাশ দেখায় ব্যস্ত তাঁরা। শীতলক্ষ্যা ছেড়ে আমরা ধলেশ্বরী নদী হয়ে মেঘনা নদীতে প্রবেশ করলাম। তারায় তারায় ভরে আছে মেঘহীন আকাশ। রাতের অপার্থিব সৌন্দর্য উপভোগ করতে করতে ভৈরব পর্যন্ত চলে এলাম। এরপর ছাদ থেকে নেমে কেবিনে চলে গেলাম। ভৈরব ব্রিজ পার হয়ে জাহাজ নোঙর করল।

পরদিন সকাল ছয়টা। ঘোড়াউত্রা নদী ধরে কিশোরগঞ্জের নিকলীর দিকে ছুটছে জাহাজ। শরতের শুরুতেও হাওরে নদী আর ফসলের মাঠ মিলেমিশে একাকার। চারদিকে পানি আর পানি। মাঝেমধ্যে মাথা উঁচু করে আছে কিছু গাছ। দুপুরে খাওয়ার পর ধনু নদ হয়ে আমরা নোঙর করলাম মিঠামইন উপজেলার কাছে। জাহাজের পেছনে বাঁধা নৌকা আমাদের ঘাটে পৌঁছে দিল। অলওয়েদার সড়কে ইজিবাইকে ছুটলাম। দুই পাশের মনোরম দৃশ্য দেখতে দেখতে ৪০ মিনিট পর ইটনায় পৌঁছালাম।

ইটনা লঞ্চঘাটে চা খেতে খেতেই জাহাজ এসে হাজির। আবার ছোট নৌকায় জাহাজে উঠে পড়ি। ঠিক সন্ধ্যার আগে ধনু নদ দিয়ে নেত্রকোনার খালিয়াজুরীর দিকে যাত্রা করলাম। দ্বীপের মতো দূরের বাড়িঘরে ঝাপসা আলো দেখা যাচ্ছে। মাছ ধরার নৌকায় জোনাকির মতো আলো জ্বলে উঠেছে, মালবাহী নৌযান কাছে এসে প্রকৃতি উপভোগে ব্যাঘাত ঘটাচ্ছে। এভাবে প্রায় মধ্যরাতে আমরা সুরমা নদী দিয়ে টাঙ্গুয়ার হাওরের প্রবেশমুখে পৌঁছাই। এটি জামালগঞ্জের গজারিয়া বাজারের কাছে। সেখানেই নোঙর করল জাহাজ। মাস্টার জানান, টাঙ্গুয়ার হাওরে হাউসবোটের মতো বড় জাহাজ চলতে পারে না, যেতে হয় আঁকাবাঁকা নদী ধরে।

ভোরে ইঞ্জিন চালু হওয়ার আগেই আমরা ১০-১২ জন ছাদে হাজির। তখনই মাস্টার এসে জানান, ছাদে থাকা অনিরাপদ। হাওরের অনেক জায়গায় বিদ্যুতের তারের নিচ দিয়ে যেতে হয়। কোথাও পানি বেশি থাকলে বিপদ হতে পারে। কী আর করা, মাস্টারব্রিজের সামনে চেয়ার পেতে বসে গেলাম। কিছুক্ষণের মধ্যেই দূরে মেঘালয়ের পাহাড়ের সারি দেখা গেল। জাদুকাটা-রক্তি নদীর শাখা বৌলাই নদ ধরে ঘণ্টা তিনেক চলার পর পাটলাই নামের একটি নদে ঢুকে পড়লাম।

ওয়াচ টাওয়ার এলাকায় পৌঁছাতে পৌঁছাতে সকাল নয়টা। জাহাজ নোঙর করল টাওয়ার থেকে প্রায় তিন কিলোমিটার দূরে। সেখান থেকে ছোট নৌকায় ছুটলাম ওয়াচ টাওয়ারে। হিজল–করচের বন পেরিয়ে চারতলা টাওয়ারে উঠে মন ভরে গেল। চারপাশে পানি আর পানি, দূরে মেঘালয়ের উঁচু পাহাড়ের ওপর মেঘের আনাগোনা। একসময় হিজলের বনে বুকসমান পানিতে সদলবল গোসলও সেরে ফেললাম।

জাহাজে ফিরে সেই বৌলাই নদ ধরে ঘণ্টা দুয়েক পর আমরা তাহিরপুরের ডাম্পের বাজার ব্রিজের পাশে নামি। সেখান থেকে কখনো স্থলপথে, কখনো খেয়ানৌকায় পার হয়ে ঘুরে বেড়াই সীমান্তবর্তী শহীদ সিরাজ লেক, বারেকের টিলা ও শিমুলবাগান। সব গন্তব্য ঘুরে ডাম্পের বাজারে ফিরে রাত আটটার দিকে উঠে পড়ি জাহাজে।

রাতে ছিল স্থানীয় গানের দল ‘গানপুর’–এর মনমাতানো পরিবেশনা। শাহ আবদুল করিম, রাধারমণ দত্ত, হাসন রাজা আর লালন শাহের গান শুনলাম। জাহাজের ছাদে বসে গভীর রাত পর্যন্ত আকাশে তারার মেলা মন ভালো করে দিল।

ভোর সাড়ে পাঁচটায় নোঙর তুলল জাহাজ, শুরু হলো আমাদের ফিরতিযাত্রা।

- Advertisement -spot_img

More articles

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisement -spot_img

Latest article